একবার ভিতরটা পাথর হয়ে গেলে, কারো কথায় আর কষ্ট লাগে না!

ভিতরের পাথর – এক অন্য আখ্যান

ভিতরের পাথর

রাত ছিল একেবারে নিশ্চুপ। শহরের শব্দ থেমে গেছে, শুধু জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রুদ্র তাকিয়ে আছে দূরের আলো ঝাপসা ছায়ার দিকে। তার ভেতরটায় অদ্ভুত এক ঝড় চলছে। বহু বছর ধরে কাছের মানুষের অবহেলা, ভুল বোঝাবুঝি আর অবিরাম আঘাত তাকে ধীরে ধীরে বদলে দিয়েছে।

একসময় রুদ্র ছিল খুব হাসিখুশি, মানুষের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করত না। বন্ধুরা বলত, “তুই খুব নরম মানুষ, তোর জন্য সবাই কিছু না কিছু করতে পারবে।” কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন ছিল। যতবারই সে ভরসা করল, যতবারই প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসল, প্রতিবারই কেউ না কেউ ভেঙে দিয়েছে তার ভরসার প্রাচীর।

প্রথমে কষ্ট পেয়েছে, কান্না এসেছে, রাত জেগে চোখ ভিজিয়েছে। তারপর ধীরে ধীরে তার হৃদয়ের ভেতরটা জমে গেছে এক অদৃশ্য বরফে। সেই বরফই তাকে শিখিয়েছে— “যদি ভেতরটা পাথর হয়ে যায়, আর কেউ তোমাকে কষ্ট দিতে পারবে না।”

রুদ্র বুঝল, বাইরে হাসিমুখে চলাফেরা করতে হলে নিজের ভেতরের জগৎকে রক্ষা করতে হয়। তাই সে আর কাউকে তার ভিতরের নরম জায়গায় ঢুকতে দিল না। বন্ধুত্ব থাকবে, সম্পর্ক থাকবে, কিন্তু সেই অন্তরের চাবি সে আর কারও হাতে তুলে দেবে না।

একদিন তার খুব কাছের একজন জিজ্ঞেস করল,

— “তুই এত চুপচাপ হয়ে গেলি কেন? আগের মতো আনন্দে মেতে উঠিস না কেন?”

রুদ্র হেসে উত্তর দিল,

— “আগে ভিতরটা ছিল মাটি, সহজেই পায়ের ছাপ পড়ত। এখন ভিতরটা পাথর, তাই কেউ যত জোরেই পা রাখুক, আর চিহ্ন থাকে না।”

তার এই পরিবর্তন বাইরে থেকে কঠিন মনে হলেও ভেতরে ছিল শান্তির ঝর্ণা। সে আর মানুষের কথায় দমে যায় না, কটাক্ষে ভেঙে পড়ে না। ভালোবাসা থাকলে সে গ্রহণ করে, না থাকলেও নিজের পৃথিবী সাজিয়ে নেয়। নিজের পাথুরে ভিতরের নিচেই লুকিয়ে রাখে এক অসীম দৃঢ়তা।

রুদ্র এখন জানে— জীবন সবসময় ন্যায্য হয় না, কিন্তু ভেঙে না পড়ে দাঁড়িয়ে থাকাই আসল জয়। যে ভিতরটা একদিন ভাঙা কাঁচের মতো ছিল, আজ সেই ভিতরটাই পাথরের মতো দৃঢ়; আর সেই দৃঢ়তাই তাকে মুক্তি দিয়েছে সব যন্ত্রণা থেকে।