"রাতের নিঃশব্দ ভয় আর আল্লাহর আশ্রয়"
রাত গভীর হয়। চারদিকে নিস্তব্ধতা।
ঘড়ির কাঁটা যেন কানে কানে বলে—“এখন তুমি একা।”
সেই একাকিত্বে যদি হঠাৎ কল্পনায় বা চোখে ভেসে ওঠে কোনো অদ্ভুত ছায়া, অশরীরী ভয় কিংবা অজানা আতঙ্ক—তাহলে কী করব?
অনেকেই আছেন, যারা রাতে ঘুমাতে গেলেই একটা অজানা ভয়ের মধ্যে পড়েন। হয়তো জানালার বাইরে কোনো আওয়াজ, কিংবা ছায়া দেখে মনে হয়—কেউ আছে। আবার অনেকেই বলেন—"ঘুমাতে গেলেই দম বন্ধ লাগে", কেউ বা বলেন—"কেউ পাশে বসে আছে বলে মনে হয়।"
এমন সব অনুভব একেবারে অস্বাভাবিক নয়, বরং শয়তান ও জিনের ধোঁকায় এমনটা হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের রাসূল (সা.) আমাদের জন্য রেখে গেছেন এমন কিছু দোয়া, আমল ও পদ্ধতি, যেগুলোর মাধ্যমে আমরা নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ ও ভীতিহীন রাত কাটাতে পারি।
চলুন জেনে নিই—ইসলামের আলোকে রাতে ভয় পেলে বা খারাপ কিছু দেখলে করণীয় কী কী।
---
১. ঘুমানোর আগে বিশেষ দোয়া ও আমল
ঘুমানোর পূর্বে এই কাজগুলো নিয়ম করে করলে—শয়তান, জিন বা অশরীরী কিছুর ভয় থাকবে না:
আয়াতুল কুরসী (সূরা বাকারা ২:২৫৫) পড়া
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
“যে ব্যক্তি প্রতিরাতে আয়াতুল কুরসী পড়ে, তার উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন ফেরেশতা নিযুক্ত থাকেন, যে তাকে রক্ষা করেন। এবং শয়তান তার কাছে আসে না।” (বুখারি)
সূরা ফালাক ও সূরা নাস তিনবার করে পড়া
এই দুটি সূরা রাসূল (সা.) নিজ হাতে পড়ে দেহে ফুঁ দিতেন ও নিজেকে মুছতেন।
এগুলো রাতের জন্য ঢাল।
বিসমিল্লাহ বলে প্রতিটি দিক থেকে নিজেকে ঝাড়ু দিয়ে নেওয়া (তিনবার করে)
রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে এভাবে নিজেকে ঝাড়তেন — যেন নিজের চারপাশে আল্লাহর নিরাপত্তা চাদর টেনে দেন।
---
২. খাটে উঠার আগে এবং ঘুমাতে যাওয়ার আগ মুহূর্তে করণীয়
খাটে বিছানায় বসে প্রথমে “বিসমিল্লাহ” বলুন
কারণ হাদিসে আছে—শয়তান তার অস্তিত্ব নিয়ে উপস্থিত থাকে, কিন্তু "বিসমিল্লাহ" বললে সে দূরে চলে যায়।
দুই রাকাত নফল নামাজ পড়া
রাতের নফল নামাজ মনকে শান্ত করে, আতঙ্ক কমায়। মনে রাখবেন, নামাজ শুধু ইবাদত নয়, এটি মানসিক শান্তিরও পথ।
---
৩. যদি ঘুমানোর পর ভয় পাই বা কিছু খারাপ দেখি (দুঃস্বপ্ন বা অদ্ভুত অনুভব)
রাসূল (সা.) বলেছেন—
“তোমাদের কেউ যদি স্বপ্নে এমন কিছু দেখে যা তাকে অশান্ত করে, তবে সে যেন তার বাঁ পাশে তিনবার থুতু ফেলে (হালকাভাবে), এবং ‘আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম’ বলে, এবং সে যেন কাউকে সেই স্বপ্ন না বলে।” (বুখারি ও মুসলিম)
অর্থাৎ:
বাঁ পাশে তিনবার ফু দিন (হালকা ভাবে থুথুর মতো)
বলুন: আউজু বিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম
অন্য কাউকে সেই স্বপ্ন বলবেন না
উঠে ওজু করে দুই রাকাত নামাজ পড়ে ঘুমালে শয়তান পালায়
---
৪. ঘুমের আগে ৩টি গুরুত্বপূর্ণ দোয়া (প্রমাণসহ)
(ক)
“বিসমিকা আল্লাহুম্মা আমুতু ওয়া আহইয়া।”
(তোমার নামে হে আল্লাহ! আমি মরি ও বাঁচি।)
[বুখারি, ৬৩২৪]
(খ)
“আল্লাহুম্মা ইন্নি আ’উযু বিকা মিনাল হুম্মি ওয়াল হাযান...”
(হে আল্লাহ, আমি তোমার নিকট আশ্রয় চাই দুশ্চিন্তা ও দুঃখ থেকে...)
(গ)
দু’হাত মুখমণ্ডলে বুলিয়ে সূরা ইখলাস, ফালাক ও নাস পড়া
---
৫. একা থাকলে করণীয় ও আত্মা বা অদৃশ্যের ভয় হলে করণীয়
নিজের ঘরে কুরআন তিলাওয়াত চালু রাখুন, বিশেষ করে সূরা বাকারাহ। হাদিসে বলা হয়েছে:
“তোমরা তোমাদের ঘরগুলোকে কবরস্থানে পরিণত করো না। নিশ্চয় শয়তান সেই ঘর থেকে পালিয়ে যায় যেখানে সূরা বাকারাহ তিলাওয়াত করা হয়।” (মুসলিম)
ঘরে “আয়াতুল কুরসী” লিখে রাখুন, বা উচ্চস্বরে পড়ুন
ঘরের কোণায় কোণায় “বিসমিল্লাহি আলা দীনী ওয়া নাফসি ওয়া দারী” বলুন।
(এই দোয়ার মাধ্যমে আপনি আপনার পুরো ঘরকে আল্লাহর নামে সুরক্ষিত করেন)
---
৬. গভীর রাতে হঠাৎ ভয় পেলে বা খারাপ কিছু অনুভব করলে করণীয়
উচ্চস্বরে বলুন: আউজু বিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম
হাত-পা ধুয়ে ২ রাকাত নামাজ পড়ুন
দরজা-জানালায় “বিসমিল্লাহ” বলে তাকিয়ে পড়ুন
মোবাইলে সূরা বাকারাহ বা সূরা ফালাক-নাস চালু করে দিন
নিজে নিজে বলুন: "আমার সঙ্গে আমার রব আছেন, ভয় কীসের?"
---
শেষ কথায় শান্তি আছে
রাতের নিঃশব্দতায় ভয় আসতেই পারে। কিন্তু আমাদের প্রিয় নবী (সা.) আমাদের জন্য রেখে গেছেন এমন সব দোয়া, যেগুলো শুধু শব্দ নয়, আত্মার ওষুধ।
ভয়ের সময় আসলে আমরা নিজেকে বুঝাই—আমি একা নই। আমার প্রভু আছেন। তিনি বলেছেন:
"যারা বলে, আমাদের প্রভু আল্লাহ, এবং এরপর তারা অবিচল থাকে, তাদের ভয় করার কিছু নেই, তারা দুঃখিতও হবে না।" (সূরা আহকাফ: ১৩)