সবচেয়ে আপন যে, সেই হয় পর”
রিয়াজ আর রাশেদ—দুই বন্ধু, দুই ভাইয়ের থেকেও বেশি। একই পাড়ায় বড় হওয়া, একই স্কুল, একই মাঠে খেলাধুলা, এমনকি একসাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিও। রিয়াজ সবসময় একটু চুপচাপ স্বভাবের, আর রাশেদ সদা হাসিখুশি, প্রাণবন্ত—তবে একটু চালাকও। অনেকেই বলত, “রাশেদ বড় হবে অনেক দূর যাবে।” আর রিয়াজ? সে তো শুধু হাসত।
রিয়াজের পরিবার একটু মধ্যবিত্ত হলেও মূল্যবোধ ছিল দৃঢ়। বাবার ছোট্ট চাকরি, মায়ের সংসার চালানোর সংগ্রাম, আর ছোট দুই বোন। অন্যদিকে রাশেদের পরিবার ছিল অবস্থাসম্পন্ন। তবুও তাদের বন্ধুত্বে কোনো ফাঁক ছিল না।
একদিন রাশেদ একটা ব্যবসা শুরু করার প্ল্যান করল—ডিজিটাল মার্কেটিং। সে বলল, “রিয়াজ, তুই আমার সাথে থাকলে আমি নিশ্চিন্ত। টাকা তোদের বাসায় হয়ত কম, কিন্তু তোকে আমি আমার ভাইয়ের থেকেও বেশি বিশ্বাস করি।”
রিয়াজ প্রথমে না করলেও, পরে রাজি হয়। সে নিজের সঞ্চয়ের সামান্য টাকা, বোনের গহনা বিক্রি করে কিছু টাকা তুলে দিল। এমনকি বাবার পেনশনের টাকাও আনলো—শুধু বন্ধুর জন্য।
শুরুর দিকে ব্যবসা ভালোই চলছিল। রিয়াজ দিন-রাত খেটেই যাচ্ছিল, আর রাশেদ ক্লায়েন্ট হ্যান্ডেল করত, স্মার্টলি কথাবার্তা বলত, ফেসবুকে লাইভ করত। সবাই বলত, "ওয়াহ! কী পার্টনারশিপ!"
কিন্তু হঠাৎ করেই রাশেদ যোগাযোগ কমিয়ে দেয়। ফোন ধরত না, অফিসেও আসত না। একদিন দেখা গেল—অফিস বন্ধ, শাটার নামানো, রাশেদের বাসায় তালা ঝুলছে। কেউ জানে না কোথায় গেল।
রিয়াজ হিম হয়ে গেল। টাকা, স্বপ্ন, সময়—সবই শেষ। শুধু শেষ হয়নি একটার—আঘাত।
সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক ছিল বিশ্বাসঘাতকতা। যাকে ভাইয়ের মতো জানত, সে-ই পুরোটা প্ল্যান করে ঠকিয়েছে। মানুষের বিশ্বাসে এমন খোঁচা লাগে, যেটা বাইরের কেউ দিতে পারে না।
রিয়াজ ভেঙে পড়ল, পরিবারের চোখে শুধু হতাশা। কিন্তু একদিন, মায়ের একটা কথা তার ভেতর জ্বালিয়ে দিল আগুন। মা বলেছিল, “বাবা, কষ্ট দিয়ে যদি সত্যি বোঝা যায় মানুষ কে, তাহলে এই কষ্ট খুব দামি।”
রিয়াজ উঠে দাঁড়াল। সে আবার শুরু করল—এইবার একা। নিজে কাজ শিখল, ছোট ছোট কাজ নিল, রাত জেগে প্রজেক্ট করল। তিন বছরে সে গড়ে তুলল নিজের ছোট কোম্পানি—নামের পাশে ‘ভালোবাসা আর বিশ্বাস’ শব্দটা সে কেবল অফিসের দেয়ালে রাখল, মনের ভেতর নয়।
একদিন এক ফাইভ স্টার হোটেলে প্রেজেন্টেশনের সময় হঠাৎ চোখে পড়ে—রাশেদ সামনে বসে, এক ক্লায়েন্টের সাথে, চোখে অনিশ্চয়তা।
রিয়াজ হাসে, এগিয়ে যায় না। কারণ সে জানে—কোনো উত্তর সবচেয়ে তীব্র হয় ‘নীরবতা’ দিয়ে।
শিক্ষা: সবাই বলে "শত্রু বাহিরে থাকে", কিন্তু বাস্তবে সবচেয়ে ভয়ানক শত্রু থাকে খুব কাছে—আপনের মুখোশে। জীবন শেখায়—ভালোবাসতে হবে, বিশ্বাস করতেও হবে, তবে চোখ বন্ধ করে নয়। একবার যারা বিশ্বাস ভাঙে, তারা কখনো আপন হতে পারে না। সময়ই তাদের মুখোশ খুলে দেয়।
