কষ্টের গল্প বাস্তব
মা হারানো বেদনা
পুরুষ মানুষের কাছে প্রেমিকা স্ত্রী রূপে পরিনত হলে ভালোবাসা কমে যায়।
প্রেমিকাকে বিয়ে না করাই বরং ভালো!
অন্তত বছরে একবার হলেও দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে পুরুষ মানুষটা বলে " আজ ও থাকলে ভালো হতো"
অন্তত কোথাও এক কোনে ভালোবাসাটা বেঁচে থাকে। মাঝে মাঝে নাড়া দিয়ে উঠে।
মেয়ে মানুষ ঠিক তার উল্টো। তারা প্রেমিককে স্বামী হিসেবে পেলে ভালোবাসা হয়ে উঠে তীব্র।
প্রেমিককে স্বামী হিসেবে না পেলে তারা বছরে একবার না মুহূর্তে মুহূর্তে নিশ্বাস ফেলে।
কত চোখের পানি চোখেই শুকিয়ে যায়। এর হিসাবও তাদের কাছে নাই।
আমাদের মাত্র একটা মুরগি ছিলো। বেশ ডিম দিতো। আমার আর আমার মায়ের মুরগিটা খুব পছন্দের ছিলো।
১২ মার্চ ২০০৯।
খুব সকালে মা বলছে, "বাবু মুরগিটা নাই কেন? কই গেলো। পাচ্ছি না।"
আমি ঘুম চোখে বললাম, "বের হইছে, আবার সময় মতো চলে আসবে। চিন্তার কিছু নাই।"
মা রান্নাঘরে রান্না করতে চলে গেলো।
সহজ স্বাভাবিক একটা দিন।
প্রবল প্রকট কোনো বেদনা আসবে, আমরা কেউ জানি না।
পাশের বাসার একজনের মাধ্যমে খবর পেলাম মা রান্না ঘরে পড়ে আছে। একা রান্না করছিলো। কেউ জানতোও না রান্না ঘরে কী হয়েছে। বেশ অনেক সময় পর আমরা খবর পেয়েছিলাম। গিয়ে দেখি চুলা নিভে গেছে। গরম হাড়ির উপর মায়ের মুখটা হেলান দিয়ে পড়ে আছে। হাড়ির কাদা গরম ছিলো। মুখের চামড়া গলে গেছে বেশ কিছুটা।
হাতে তখনও আলু। আলু ভাজি করবে, সেই প্রস্তুতি।
জানি না কী হয়েছে।
সবাই মিলে তুলে আনলো। ধারণা করা হলো ব্রেইন স্ট্রোক। কেউ নাই আমি ছাড়া। হতদরিদ্র আমরা।
একসাইড সম্ভবত তখন প্যারালাইজড। সামান্য জ্ঞান আছে মায়ের। অতি সামান্য। ডান হাত নাড়াতে বললে বাম হাত নাড়ায়।
তারমানে ডান সাইড অনুভূতিহীন।
সবাই মাথায় পানি দিয়েছে। পোড়া জায়গায় এলোভেরা লাগিয়েছে। এটুকুই।
বোনকে খবর দেওয়া হয়েছে।
আসতে আসতে বেশ দেরি। হাসপাতালে নিলো আমার বোনই। এলাকার কেউ একবারও ভাবেনি সাথে সাথে হাসপাতালে নেওয়া উচিত ছিলো।
আমি ইন্টার পড়ি। এত বোধ তখনও আমার হয়নি।
রাজবাড়ী হাসপাতাল থেকে সেই রাতে ফরিদপুর মেডিকেলে ট্রান্সফার।
কিছুই জানি না। আমাকে জানানো হয়নি চিন্তা করবো বলে।
কিছুদিন পর আমার HSC এক্সাম।
অর্থের অভাব কতটা ভয়াবহ, একটা স্টাবলিশড-শিক্ষিত পরিবারের অভাব কতটা অসহায়ের তা হাড়ে হাড়ে দেখেছিলাম।
আমি তখন থেকেই লেখালিখি করি। অনুভূতিগুলো খুব অল্পেই ধরে ফেলতে পারতাম।
৫ দিন অসহ্যকর বেদনার দৃশ্য।
আমার মা। দুইবোনের অসহায় ভাঙাচোরা মুখ। ফরিদপুর মেডিকেলের করিডোর। অর্থের শক্তি।
মানুষের প্রবৃত্তি।
কোনোটাই সহ্য করা যায় না এমন।
সে এক ট্র্যাজেডি উপন্যাস যেন।
৫ দিনের এত এত বেদনার গল্প। যা লিখতে গেলে আঙুল বরফ হয়ে যাবে এমন।
১৭ মার্চ ২০০৯।
আমি দুপুরে শুয়ে ছিলাম। কতটুকু ছেলে আমি?
পাশের বাসার একজন এসে বলে- "নাসির তোর বোন টাকাপয়সা নিয়ে ফরিদপুর যেতে বলছে৷ টাকা লাগবে।"
কোথায় টাকা?
আমি তো কিছুই জানি না!
বুঝতে পারি কিছু হয়েছে। জানালা দিয়ে ভেসে আসে মানুষের কথা। যে জানালা দিয়ে ভেসে আসতো সজনে গাছের ডালে বসা পাখির কলতান, সেই জানালা দিয়েই আমার রুমে ঢোকে একটা বাক্য। কে যেন বলছে- "নাসিরের মা নাকি মারা গেছে।"
তারপর কী হলো আর লিখতে পারি না।
মেনে নিলাম। বেঁচে আছি। ভালো আছি।
সবসময় সান্ত্বনা পাই। যে মানুষটার বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুটাই বেশি শান্তির ছিলো, সে মানুষটা মরে গিয়েই খুব ভালো হয়েছে।
এর থেকে শান্তির আর কিছু ছিলো না আমার মায়ের জন্য।
কষ্ট আছে। অসীম শূন্যতা আছে।
সেটুকু শুধু আমার।
আর কারো না। কোনো পাঠকের না। তাই তা যথার্থ প্রকাশ করি না।
আজকের দিনটাও অন্যান্য দিনের মতোই।
রাতে একটা বিয়ের দাওয়াত আছে।
যাবো। খাবো। বাসায় আসবো। ঘুমাবো।
আমার মাও তো ঘুমিয়ে আছে। অনন্ত আঁধারে।