লোভ মানুষকে ধ্বংস করে | অতি লোভে তাতি নষ্ট

 অতি লোভে তাঁতি নষ্ট

অতি লোভে তাঁতি নষ্ট

বিয়ের কয়েকদিন পর আমার স্ত্রী একটা আবদার করেছিলো আমার কাছে। না, আহামরি তেমন কিছু নয়। আমি যেন প্রতি মাসে আমার ইনকামের একটা ছোট্ট অংশ তার হাতে তুলে দেই। আর সেই টাকাটা সে তার প্রয়োজন মত খরচ করবে।


নতুন বউয়ের আবদার ক্ষুন্ন করে দাম্পত্যের শুরুতেই মন কষাকষি চাইনি আমি। আর তাছাড়া আমি যতই তার সকল আবদার পূরণ করিনা কেন, তারপরও তার একান্ত নিজের কিছু প্রয়োজন তো থাকতেই পারে। 


সুতরাং বউয়ের আবদার মোতাবেক প্রথম মাসের ইনকাম থেকে অল্প কিছু টাকা তার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। সে-ও ভারি খুশি হয়েছিলো আমার দায়িত্বশীলতা দেখে।


এভাবেই প্রতি মাসের দুই তারিখে আমার ইনকামের একটা অংশ তার হাতে তুলে দিতাম। 


আমি বাজারে ভুসি মালের ব্যবসা করি। এদিক সেদিক, ইজারা, দেনা- পাওনা মিটিয়ে মাস শেষে যা দাঁড়ায় তা দিয়ে বেশ চলে যায়। তবে ঝামেলা বাঁধল বিয়ের দুইবছর পর।


রোজকার মত সেদিনও গোডাউনে বসে বসে ব্যবসার তদারকি করছিলাম। হঠাৎ দেখি আমার গোডাউনে শরিয়ত এসেছে। শরিয়ত আমার স্কুলজীবনের বন্ধু। বেশ কিছু বছর এলাকার বাহিরে ছিলো সে। শহরে নাকি কিসের একটা ব্যবসা করে। কয়েক বছরে বেশ মোটা অংকের টাকা কামিয়েছে। কিন্তু কি ব্যবসা করে সে বিষয়ে শরিয়ত কাউকে কখনো বলেনি।


শরিয়তের আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার মত ব্যাপারটা আমার মনকে ভাবিয়ে তুলছিলো। কী এমন ব্যবসা করে সে, যে কয়েকবছরে লাখ লাখ টাকার মালিক হয়ে গেলো!

ব্যবসা তো আমিও করি, কিন্তু সবকিছু বাদ ছাদ দিয়ে মাস শেষে হাতে যা দাঁড়ায় তা দিয়ে সংসার টা চলে কোনরকম। 


সেদিনের পর থেকে মাঝেমধ্যেই শরিয়ত আমার গোডাউনে আসতো। কথাবার্তা হতো দুজনের। আর যতক্ষণ আমার কাছে থাকতো,দেখতাম ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকতো সে। একদিন কথার ছলে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘দোস্ত ফোনে কি এমন করিস, যে সারাক্ষণ ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকা লাগে? নাকি ভাবিকে রেখে প্রেম টেম করিস আবার?’


শরিয়ত একটা মিশ্র হাসি হেসে বললো, ‘আরে না। আমার যত কারবার সবই তো এই মোবাইলের ভিতরে। আসলে, তোকে বলেছি আমি ব্যবসা করি। কিন্তু কি ব্যবসা করি সেটা বলা হয়নি।’


আমার কৌতূহলী মন আরও ছটফট করতে থাকলো শরিয়তের গোপন ব্যাবসা সম্পর্কে জানবার জন্য।


বললাম, ‘হ্যাঁ। তা তো বলিসনি। পাছে যদি আমিও তোর ব্যবসায়ে ভাগ বসাই সেই ভয়ে।'


সে হো হো করে হেসে জবাব দিলো, ‘আরে না। তোর কাছে আবার গোপনের কি আছে। শোন তাহলে, বর্তমানে অনলাইনের যুগে দেশ যেমন এগিয়ে যাচ্ছে। তেমনি ব্যবসা গুলোও রয়েছে আরও কয়েকধাপ এগিয়ে। বুঝলি? দরকার শুধু একটু ধরে নেওয়ার মত মাথার।’


- ‘ঠিক বুঝলাম না।’


- ‘সেয়ার বাজারের নাম তো নিশ্চয় শুনেছিস?’


- ‘হ্যাঁ।’


- ‘অনেকটা সেয়ার বাজারের মতনই। তবে এইখানে সেয়ার বাজারের মত ওত ধৈর্যের প্রয়োজন পড়েনা। হ্যান্ড টু হ্যান্ড। এই এক লাখ দিলাম, কয়েকমিনিটে আবার ডাবল করে নিয়ে নিলাম।’


- ‘বুঝলাম না।’


- ‘আরে বেটিং এর কথা বলছি। বর্তমানে এই বেটিং এর মাধ্যমে কত কত মানুষ রাতারাতি কোটিপতি হয়ে যাচ্ছে। এই আমাকে দেখছিস না?’


শরিয়তকে দেখে আরও অনুপ্রানিত হই আমি। উৎসুকভাব নিয়ে জিজ্ঞাসা করি, ‘তা আমাকেও একটু পথটা বদলে দে। এই ভুসি বেচে আর কতদিন?’


- ‘তুই বন্ধু মানুষ যখন বলছিস তখন তো সাহায্য করাই যায়। আচ্ছা ঠিক আছে তোকে দেখিয়ে দিচ্ছি।’


তারপর সে তার মোবাইলটা বার করে একটা বেটিং সাইটে গিয়ে আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে একশো ডলার ইনভেস্ট করলো। পাঁচ মিনিট পর তার কারবার দেখে তো আমার চোখ কপালে উঠবার অবস্থা। এ দেখি আলাদিনের দৈত্যের চেয়ে কম কিছু না!


লোভ জেগে উঠলো আমার মনে। ঠিকি তো, আমি এক সপ্তাহে যেই টাকাটা ইনকাম করি,সেই টাকাটা শরিয়ত কয়েক মিনিটে ইনকাম করে দেখিয়েছে। তাও আবার কোনরকম পরিশ্রম ছাড়াই!


না এই ভুসিমাল বেচা-কেনা আর নয়।। আমিও বেটিং করবো সিদ্ধান্ত নিলাম। শরিয়ত আমাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিলো। কয়েকটা সাইটের সাথেও পরিচয় করিয়ে দিলো। এখন শুধু বাকি টাকা ইনভেস্ট করা আর কামানো!


প্রথম কয়েক সপ্তাহ অল্প অল্প করে ইনভেস্ট করলাম। অর্থ উপার্জনের এত সহজ পথ থাকতে এতদিন বোকার মত চাল, ডাল বিক্রি করে গিয়েছি। নিজেকে মনে মনে ধিক্কার দিলাম, নিজের বোকামির জন্য।


যত দিন যেতে থাকলো আমার অভিজ্ঞতা আরও পক্ত হতে লাগলো। কাচা টাকা ইনকামের এমন সহজ পথ আছে আগে যদি জানতাম, গোটা একটা শহর কিনে নিতাম।


ধিরে ধিরে লোভ পেয়ে বসলো আমাকে। অল্প অল্প ইনভেস্ট করে আর পোষাচ্ছে না। এবার বড় দান মারতে হবে। এরই মাঝে বেটিং সাইটের আরও কিছু এজেন্টের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। তাদের ভিতরে একটা এজেন্টের সাথে বেশ কিছুদিন খেলার পর ধিরে ধিরে সখ্যতা গড়ে উঠলো আমাদের। জাতে বাঙালি তবে থাকে লাস ভেগাস। আর সেখান থেকেই এই খেলা পরিচালনা করে সে। শুনেছি পৃথিবীর বুকে লাস ভেগাসকে জুয়াড়িদের গডফাদার বলা হয়। আর সেই বৃহত্তর শহরে একবার বিচরন করতে পারলে আর কি লাগে! 


হঠাৎ করে উন্নতি হতে দেখে এলাকার সবাই তো জিজ্ঞাসা করেই, সেই সাথে আমার স্ত্রীও মাঝেমধ্যে বলে বসে, ‘তুমি কি গোডাউনের ভিতরে আলাদিনের চেরাগ খুঁজে পেয়েছো নাকি?’


ওদের এমন কথায় আমি শুধু মুচকি মুচকি হাসি। আসলেই আমি আলাদিনের চেরাগ খুঁজে পেয়েছি। আরও আগে যে কেন পেলাম না। বিয়ের পর থেকে স্ত্রীকে দামি কোনকিছু দিতে পারিনি। একদিন পাশের বাসার এক ভাবি আমাদের বাসায় এসে একটা গলার চেইন দেখিয়ে বড্ড বড় মুখ করে বলেছিলো, ‘এই গোল্ডের চেইনটা আমার স্বামী কিনে দিয়েছে।’


ভাবছি আমিও আজকে একটা চেইন কিনে নিয়ে যাব। তারপর আমার স্ত্রীও সেই ভাবির মত গর্ব করে আমার নামে বলবে সবার কাছে।


সেদিন রাতে ফেরার সময় একটা দামি চেইন কিনে নিয়ে গেলাম। স্ত্রীকে চেইনটা দেখানোতে সে যতটা না খুশি হলো তার চেয়ে প্রশ্ন করলো বেশি। আজকাল সুমির প্রশ্ন করার বাতিকটা একটু বেশিই হয়ে গিয়েছে। যা আমার কাছে বড্ড বিরক্তিকর লাগে।


সে যা ভাবে ভাবুক,তার কাজ ঘর সামলানো, সে ঘর সামলাক। দুনিয়ার খবর জেনে কাজ নেই।


কিন্তু কথায় আছে না, পিপিলিকার ডানা গজায় মরিবার তরে।' এই কথাটা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। 


আমার ভাগ্য বেশিদিন সহায় দিলো না। লোভ আর অহংকার আমাকে ধিরে ধিরে পতনের দিকে নিয়ে যেতে থাকলো। নতুন একটা এজেন্টের সাথে মেম্বারশিপ করতে গিয়ে বড় রকমের একটা ধরা খেলাম। সেই থেকেই আমার পতন শুরু হলো।


একের পর এক লস খেতে লাগলাম। এই কয়েকমাসে যা জমিয়েছিলাম, তার পুরোটাই ধিরে ধিরে হারতে বসলাম। সোজা পাহাড়চূড়া থেকে অথৈ সাগরে ঝাপ মারার মত অবস্থা হলো।


এই কয়েকমাসে যতজন এজেন্টের সাথে ভাব জমে উঠেছিলো সবাই এক এক করে ছন্নছাড়া হয়ে গেলো। আমার উন্নতি দেখে যতজন বন্ধু কাছে এসেছিলো সব এক এক করে হারিয়ে গেলো। এড়িয়ে চলতে লাগলো আমাকে। এদিকে লোভ যেন আমাকে গেঁড়ে বসেছে একবারে। শেষমেশ স্ত্রীকে গিফট করা চেইনটাও বাদ দিলাম না। ওটাও বিক্রি করে খেলায় লাগিয়ে দিলাম। কিন্তু ভাগ্য যদি সহায় না হয় তাহলে ছটফটায়ে আর কি লাভ?


একের পর এক লস খাওয়াতে মেজাজ হতে লাগলো খিটখিটে। কাউকে যেন আর সহ্য হয়না আমার। বিশেষ করে আমার স্ত্রীকে। সে ভালো কোনো উপদেশ দিতে আসলেও আমার কাছে তা তিক্ত লাগে। 


এদিকে বেটিংয়ের চক্করে আমার ভুসিমালের ব্যবসাও লাটে উঠবার মত অবস্থা। সব খইয়ে যখন একবারে নিঃস্ব, পথে বসার মত অবস্থা ঠিক তখন বুঝতে পারলাম, অতিরিক্ত লোভ আর আশা মানুষকে ঠিক কোন জায়গাতে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাতে পারে।


ছিলাম সাধারণ একজন ব্যবসায়ি। অল্প পুঁজি, স্বল্প লাভ হলেও মনে শান্তি ছিলো,সংসারে সুখ ছিলো। দাম্পত্য জীবনে ভালোবাসায় ভরপুর ছিলো। ঠিক যেদিন থেকে লোভ পেয়ে বসলো আমাকে, সেদিন থেকে আমার জীবনের সুখ, শান্তি আর ভালোবাসা মুখ থুবড়ে পড়ে মা*রা গিয়েছে।


নিজের ভুলগুলো যখন বুঝতে পেরে অনুতাপের অথৈ সাগরে ডুবছি। ঠিক তখনি আমার স্ত্রী পাশে এসে দাঁড়ালো। 


আমার হাতে একটা ছোট্ট ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বললো, ‘তুমি আবার প্রথম থেকে শুরু করো। উপরওয়ালা ঠিক মুখ তুলে চায়বে আবার। আবার সুখ ফিরে আসবে আমাদের।’


ব্যাগটা হাতে নিয়ে দেখলাম সেখানে কিছু টাকা আর গহনা আছে।


ব্যাগটা হাতে নিয়ে অবাক চোখে জানতে চেয়ে বললাম, ‘তোমার সব গহনা তো আমি জুয়ারিতে বিক্রি করে দিয়েছিলাম।’


- ‘এগুলো আমার মায়ের। আর টাকাগুলো তুমি এতদিন ধরে আমাকে হাত খরচার জন্য যেগুলো দিয়ে এসেছো সেইগুলো জমিয়ে হয়েছে। সংসারে সুখ না থাকলে ওসব গহনা আর টাকা দিয়ে কি করবো? তুমি ওগুলো দিয়ে আবার নতুন করে ব্যবসা শুরু করো।’


- ‘কিন্তু... ’


- ‘কোনো কিন্তু না। আমার সবচাইতে দামি অলংকার তো তুমি। তুমি থাকলেই আমার সব হবে। সবার জীবনে কিছুক্ষণের জন্য হলেও দুঃসময় আসাটা প্রয়োজন। কারণ সুসময়ে কাছের মানুষ চেনা না গেলেও দুঃসময় মানুষ চেনায়। তুমি যে নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছো এটাই অনেক। তবে একটাই অনুরোধ একই পথে দ্বিতীয়বার আর যেওনা।’


আমার মুখ দিয়ে আর কোন কথা বার হলো না। নিজের অনুতাপ যেন ভিতরটাকে জ্বা*লিয়ে পু*ড়িয়ে সব ভস্ম করে দিচ্ছে। বুক ফেটে আর্তনাদ বেরিয়ে আসতে চাইছে। সবকিছু ছাড়িয়ে স্ত্রীকে বুকে টেনে নিলাম। যদি এসবের থেকে একটু পরিত্রাণ মেলে সেই আশায়। 


(সমাপ্ত).. 

গল্প || ভুল

আশিক_মাহমুদ

-------------

মন ছুঁয়ে যাওয়া গল্প পড়ুন।